ই-পাসপোর্ট হলো ইলেকট্রনিক পাসপোর্টের সংক্ষিপ্ত রূপ। যা পাসপোর্ট হোল্ডারকে এমএরপি পাসপোর্টের চেয়ে অধিক অধুনিক এবং নিরাপদ পাসপোর্ট প্রদান করে। ই-পাসপোর্ট মূলত সাধারণ এমআরপি পাসপোর্টেরই আধুনিক ভার্সন। তাই সাধারণ পাসপোর্টের মতই ই-পাসপোর্ট করতেও প্রায় একই রকমের ব্যক্তিগত তথ্য এবং কাগজ পত্রের প্রয়োজন হয়। তবে সাধারণ পাসপোর্টের তুলনায় ই পাসপোর্টের আবেদনের সুবিধা হলো এখনে প্রয়োজনীয় কাজপত্র গুলো আলাদা করে সত্যায়ন করার প্রয়োজন হয় না। এমনকি ই-পাসপোর্টের আবেদন করতে আলাদা করে ছবি তোলার প্রয়োজন হয় না। পাসপোর্ট তৈরির অভিজ্ঞতাকে আরো উন্নত করার জন্য এই পোষ্টে আমরা ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে সেটি নিয়েই কথা বলব। চলুন তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক৷
আরও পড়ুন : ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের আবেদন করার নিয়ম ২০২৫
ই-পাসপোর্ট কি?
ই-পাসপোর্ট এর পূর্নরূপ হচ্ছে ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট। যা একটি ইলেকট্রনিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপ যুক্ত বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট সিস্টেম। এই পাসপোর্টে ইলেকট্রনিক চিপ যুক্ত থাকায় এয়ারপোর্টের ই-গেট খুব সহজেই পাসপোর্ট ধারকের পরিচয় ডিটেক্ট করতে পারে। আর ই-পাসপোর্ট তৈরি করার সময় পাসপোর্ট ধারকের ছবি, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশের ছবি ইত্যাদি নেওয়া হয়। ফলে নকল ই-পাসপোর্ট তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। ২২ জানুয়ারী ২০২০ সালে পৃথিবীর ১১৯ তম দেশ হিসাবে ই-পাসপোর্ট চালু করে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১২০ টি দেশে ই-পাসপোর্ট চালু রয়েছে।
১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে?
ই-পাসপোর্ট সাধারণত পাঁচ বছর এবং দশ বছর উভয় মেয়াদের হয়ে থাকে। আবেদনকারী তার প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোন একটি ই-পাসপোর্ট নির্বাচন করতে পারবেন। তবে আবেদনকারীর বয়স যদি ১৮ বছরের নিচে কিংবা ৬৫ বছরের বেশি হলে তাকে ০৫ বছর মেয়াদি এবং ৪৮ পৃষ্ঠার ই পাসপোর্ট নিতে হবে। সাধারণত ই-পাসপোর্ট করতে কি কি লাগবে তা নির্ভর করে আবেদনকারীর বয়স, পেশা ইত্যাদির উপর। নিচে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করতে যা যা লাগে তার একটি তালিকা প্রদান করা হল :
NID কার্ড/জন্ম নিবন্ধন সনদ:
ই-পাসপোর্টের জন্য NID কার্ড/জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। আপনার বয়স যদি ১৮ থেকে ২০ বছর মধ্যে হয় তাহলে ই-পাসপোর্টের আবেদনের জন্য আপনার NID কার্ডের কপি অথবা অনলাইন ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদের যে কোন একটি প্রয়োজন হবে। কিন্তু আপনার বয়স যদি ২০ বছরের উর্ধ্বে হয় তাহলে ই-পাসপোর্টের আবেদনের জন্য আপনার NID কার্ড থাকাটা অবশ্যই অবশ্যই বাধ্যতামূলক।
নাগরিকত্ব সনদ:
ই-পাসপোর্ট করার জন্য নাগরিকত্ব সনদ প্রয়োজন হবে। আবেদনকারী যদি ইউনিয়নের বাসিন্দা হলে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নিকট থেকে নাগরিকত্ব সনদ সংগ্রহ করবেন এবং পৌরসভার বাসিন্দা হলে পৌরসভা চেয়ারম্যানের নিকট থেকে নাগরিকত্ব সনদ সংগ্রহ করবেন। এই নাগরিকত্ব সনদ ই-পাস্পোর্ট করার জন্য অবশ্যই অবশ্যই লাগবে।
অনলাইন আবেদনের কপি:
ই-পাসপোর্ট করার জন্য অবশ্যই আপনাকে অনলাইনে আবেদন করতে হবে। এটি ই-পাসপোর্ট করার প্রথম ধাপ। এই ধাপে ই-পাসপোর্ট করতে https://www.epassport.gov.bd/ সাইট থেকে যথাযথ ভাবে আবেদন সম্পন্ন করার পর আবেদনের কপিটি অন্যন্য কাগজ পত্রের সাথে সাক্ষাতকারের দিন পাসপোর্ট আফিসে জমা দিতে হবে হবে। আপনি কিভাবে নিজে নিজেই ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করবেন তা জানতে চাইলে এই পোস্টটি দেখুন: অনলাইনে ই পাসপোর্ট আবেদন করার নিয়ম।
পাসপোর্ট ফি পরিশোধের রসিদ:
অনলাইনে ই-পাসপোর্টের আবেদন করা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে আপনাকে নির্ধারিত আবেদন ফি প্রদান করতে হবে। ই-পাসপোর্টের আবেদন ফি অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমেই পরিশোধ করা যায়। আপনি অফলাইনে সরকারি বা বেসরকারি যে কোন ব্যাংকে (যেসব ব্যাংক ই-পাসপোর্টের ফি গ্রহণ করে) এ চালানের মাধ্যমে আবেদন ফি প্রদান করতে পারবেন এবং অনলাইনে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে এ চালানের মাধ্যমে আবেদন ফি পরিশোধ করতে পারবেন। তবে যেভাবেই আবেদন ফি পরিশোধ করেন না কেন ফি পরিশোধের কপি বা রসিদ অবশ্যই সংগ্রহ করে রাখতে হবে। যা পরবর্তীতে পাসপোর্ট অফিসে ই-পাসপোর্ট করার জন্য প্রয়োজন হবে।
আরও পড়ুন: পাসপোর্ট করার নিয়ম ও খরচ ২০২৫
পেশার প্রমান পত্র:
ই-পাসপোর্ট করার জন্য আবেদনকারীর পেশার প্রমান পত্র থাকাটা জরুরি। ছাত্রদের ক্ষেত্রে পেশার প্রমান পত্র হিসাবে স্টুডেন্ট আইডি এবং চাকুরিজীবীদের জন্য চাকরির কার্ড ই-পাসপোর্ট করতে প্রয়োজন হবে। তবে পেশা হিসাবে কৃষক নির্বাচন করলে তার সাপেক্ষে কোন প্রমান পত্র পেশ করতে হবে না।
বৈবাহিক অবস্থার সনদ:
প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ই-পাসপোর্টে আবেদন করার সময় বৈবাহিক অবস্থার সনদ অর্থাৎ বিবাহ সনদ কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে তালাকনামা দাখিল করতে হবে।
NOC / GO:
এটি কেবল মাত্র সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য৷ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীরা সরকারি কাজে বিদেশ ভ্রমনের জন্য ই-পাসপোর্টের আবেদন করলে তাদের GO (Government Order) প্রয়োজন হবে। আবার সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীগণ যদি ব্যক্তিগত ভ্রমণ বা প্রয়োজনের জন্য ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন তাহলে তাদের NOC (No Objection Certificate) প্রয়োজন হবে।
সাধারণ পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে?
যে কোন মেয়াদি নতুন সাধারণ পাসপোর্ট করতে মূলত একই ধরনে কাগজ পত্রের প্রয়োজন হয়। হোক সেটা ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট বা ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট। তবে সাধারণ বা ৫ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট এবং ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রের কিছু ভিন্নতা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের সকল নাগরিক ৫ বছর মেয়েদি নিতে পারলেও সকলে ১০ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট নিতে পারেন না। যারা কারণে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। তাই ই-পাসপোর্ট আবেদনের সময় আপনার নিকটবর্তী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যে যে কাগজপত্র গুলো আবশ্যই সাথে আনতে হবে সেগুলোর তালিকা দেওয়া হলো:
- অনলাইনে ই পাসপোর্টের আবেদন কপি।
- আবেদন ফি পরিশোধের চালানের কপি বা রশিদ।
- জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল ও ফটোকপি।
- ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদের মূল ও ফটোকপি। যদি আপনার বয়স ১৮-২০ বছরের মধ্যে হয় এবং জাতীয় পরিচয় পত্র না থাকে কিংবা আপনার বয়স ১৮ বছরে কম হয় তাহলে আপনি আপনার ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন সনদের মাধ্যমে ই পাসপোর্ট করতে পারবেন। ।
- পিতামাতার NID কার্ডের কপি। পিতামাতার NID কার্ডের ফটোকপি কেবলমাত্র অপ্রাপ্ত বয়স্ক আবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। প্রাপ্ত বয়স্ক আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না। উল্লেখ্য যে ১৮ বছরের নিচে কোন আবেদনকারী অভিভাবকের জাতীয় পরিচয় পত্র ব্যতিত ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।
- নাগরিকত্ব সনদের মূল কপি।
- বর্তমান পেশার প্রমাণ পত্র।
- স্থায়ী ঠিকানা, বৈবাহিক অবস্থার প্রমাণ পত্র। এই ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল, জমির খতিয়ান বা দলিল নিয়ে যেতে পারেন।
- 3R সাইজ ছবি : আবেদনকারীর বয়স যদি ৬ বছরের নিচে হয় তাহলে ই-পাসপোর্ট করতে 3R সাইজ ছবি দরকার হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আবেদনকারীর এবং তার পিতা মাতার সদ্য তোলা ল্যাব প্রিন্ট 3R সাইজ ছবি প্রয়োজন হতে পারে। তবে ছবি গুলো সত্যায়ন করার কোন প্রয়োজন হবে না।
পাসপোর্ট নবায়ন করতে কি কি লাগে:
১৮ বছরের নিচে পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে?
- জন্ম নিবন্ধন সনদ।
- পিতামাতার জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি।
- ছাত্র হলে স্টুডেন্ট আইডি কার্ড।
- বয়স ৬ বছরের কম হলে 3R সাইজ ছবি।
কিভাবে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের আবেদন করবেন?
বর্তমানে আপনি কোন দালাদের সাহায্য ছাড়াই নিজের কম্পিউটার, ল্যাপটপ এমনি কি হাতের স্মার্ট ফোন দিয়েও ই-পাসপোর্টের আবেদন করতে পারবেন। এর জন্য সর্বপ্রথম আপনাকে https://www.epassport.gov.bd সাইটে প্রবেশ করতে হবে।
তারপর সেখান থেকে Apply Onlie for e-Passport/Re-Issue বক্সে থাকা Directly to Online Application ক্লিক করে একাউন্ট তৈরি করতে হবে। একাউন্ট তৈরি করা হয়ে গেলে লগ ইন করে Apply for a new passport -এ ক্লিক করে আপনার প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য দিয়ে ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে হবে। পোস্ট বেশি দীর্ঘ হবে বিধায় এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হলো না। এই বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত একটি পোস্ট আছে আপনি চাইলে আবেদন করার সময় সেটির সাহায্য নিতে পারেন।
১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের আবেদন ফি:
পাতার উপর ভিত্তি করে মূলত পাসপোর্ট দুই ধরনের হয়ে থাকে ১. ৪৮ পৃষ্টার এবং ২. ৬৪ পৃষ্টার। ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টও এই দুই ধরনেরই হয়ে থাকে।
৪৮ পৃষ্টার রেগুলার ডেলিভারির জন্য আবেদন ফি ৫,৭৫০ টাকা, এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য আবেদন ফি ৮,০৫০ টাকা এবং সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য আবেদন ফি ১০,৩৫০ টাকা।
৬৪ পৃষ্টার রেগুলার ডেলিভারির জন্য আবেদন ফি ৮,০৫০ টাকা, এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য আবেদন ফি ১০,৩৫০ টাকা এবং সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারির জন্য আবেদন ফি ১৩,৮০০ টাকা।
উল্লেখ্য
- রেগুলার ডেলিভারির সময় হচ্ছে ১৫ কার্যদিবস।
- এক্সপ্রেস ডেলিভারির সময় হচ্ছে ০৭ কার্যদিবস।
- সুপার এক্সপ্রেস ডেলিভারির সময় হচ্ছে ০২ কার্যদিবস।
শেষ কথা:
বর্তমান সময়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলো এই ই পাসপোর্ট। ই পাসপোর্ট চালু হাওয়ার কারণে পাসপোর্ট করার ঝামেলা একেবারেই কমে গিয়েছে বললেই চলে। ই-পাসপোর্ট চালু ফলে এখন না প্রয়োজন হচ্ছে কাগজ সত্যায়নের না লাগছে দালালের পিছনে ঘুরতে। এখন নিজের আবেদন নিজেই করা যাচ্ছে খুব সহজে। আর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে আমরা শরিক হতে পেরে নিজেদের গর্বিত মনে করছি। আমরা আমাদের এই ব্লগে প্রতিনিয়ত ই পাসপোর্ট সম্পর্কিত সকল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যার ধারাবাহিকতায় আমাদের এই পোস্ট। আশা করছি ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করতে কি কি লাগে তা আপনাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। আর কিভাবে ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন তার জন্য শুরুতে মেনশন করা আমাদের পোস্টটি দেখে নিতে পারেন।